প্রাচীন রোমানরা তাদের নিজেদের হাতে অন্যের নিপীড়নের মাঝে কোনো রকম বর্বরতা দেখতে পেত না। বরং এই বর্বরতা তাদের জন্য ছিল আনন্দ ও উপভোগের উৎস! বিখ্যাত রোমান কলোসিয়ামে ৫০,০০০-এরও বেশি মানুষ একসাথে বসে নিয়মিতভাবে manus istum atque legitumum (ল্যাটিন; ইংরেজীতে A Proper and Legitimate Gladiator Show বা একটি সুষ্ঠু ও বৈধ গ্ল্যাডিয়েটর প্রদর্শনী) নামক প্রদর্শনী উপভোগ করতে আসত। সারাদিন ধরে চলা এই “খেলা”গুলোকে তিনটি অংশে ভাগ করা হতো।
প্রথম অংশকে বলা হতো Venatio (বন্য প্রাণী শিকার বা “Wild Beast Hunt”)। সাম্রাজ্যের সকল প্রান্ত থেকে জড়ো করা পশুগুলোকে ময়দানে ছেড়ে দেওয়া হতো। কখনো অভিজ্ঞ শিকারী এগুলোকে হত্যা করত আবার কখনো পশুগুলোই একে অপরের সাথে লড়াই করে মরত। আর এসবের উদ্দেশ্য ছিল শুধুমাত্র মানুষের মনোরঞ্জন। চিত্তবিনোদনের খোরাক হিসেবে গড়ে ১০,০০০ প্রাণী প্রতিবছর এভাবে জীবন দিত।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় অংশ “The Ludi Meridiani” (মধ্যপ্রহরের খেলা-Midday Games) এ বেশির ভাগ সময় মানুষকে সিংহ বা ভালুকের সাথে ময়দানে ছেলে দেয়া হতো। অনুষ্ঠানের এ অংশে পশুর চেয়ে মানুষ বেশি মরত।
আর শেষ অংশটা ছিল মূল আকর্ষণ: দ্যা গ্ল্যাডিয়েটরস (The Gladiators)। দুইজন মানুষকে আনা হতো যারা ছোরা বা তরবারির সাহায্যে আমৃত্যু লড়াই করত। অর্থাৎ একটা লড়াইয়ে একজনকে মরতেই হবে। অধিকাংশ গ্ল্যাডিয়েটররা ছিল দাশ।
জীবনের প্রতি তাদের বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই এইরকম পাশবিকতা আর সংজ্ঞাহীন বর্বরতা প্রাচীন রোমের নাগরিকদের আনন্দের একটি উৎস ছিল [১]।
প্রাচীন রোমানদের কলোসিয়ামের সেই বর্বরতার ছাপ পড়েছে এখনকার পর্ন ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে। কলোসিয়ামে সবকিছু মানুষের সামনেই ঘটত। কিন্তু পর্নে, ক্যামেরার পেছনের জগতটা কেউ দেখতে পায় না। তাই তারা জানেও না—সেখানে এতো মেয়েরা কোথা থেকে আসে। সবার কি আসলেই ক্যামেরার সামনে যৌন-ক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়ার কোনো ইচ্ছা আছে, নাকি তারা বাধ্য হচ্ছে।
সেক্স ট্রাফিকিং (Sex Trafficking) নিয়ে যদি একটু পড়াশুনা করেন, দেখবেন পর্ন ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে কলোসিয়ামের চিত্রই ফুটে উঠছে। কলোসিয়ামের দাশ মানুষ, আর পশুগুলোর মতো পর্ন ইন্ডাস্ট্রিতেও লাখ লাখ মেয়েদের পাচার করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই—মানুষের মনোরঞ্জনের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন।
ন্যাশনাল হিউম্যান ট্র্যাফিকিং রিসোর্স সেন্টারের তথ্য মতে, পাচার হওয়া নারীদের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি দেহব্যবসায় ব্যবহৃত হয়, বিশ্বে যাদের সংখ্যা আনুমানিক ২১ মিলিয়ন[২]। একটি জরিপে ৬৩% অপ্রাপ্তবয়স্ক যৌন পাচারের ভুক্তভোগীরা জানায়, অনলাইনে তাদের বিজ্ঞাপন দেওয়া ও বেচাকেনা করা হয়[৩]।
জালে আটকিয়ে ফেলে একবার কোনোমতে তাদের পর্ন অভিনয়ে বাধ্য করা গেলে দেখা যায়, তারা নিজেরাও আর এ থেকে সহজে বের হতে পারে না।[৪] গ্ল্যাডিয়েটরদের মতো পর্ন ইন্ডাস্ট্রিতে পাচার হওয়া মেয়েদের আমৃত্যু লড়ায় করতে বাধ্য করা না হলেও, একসময় তাদের অনেকের শেষ পরিণতি মৃত্যুই হয়। তারা আমৃত্যু পর্নে অভিনয় করে যায়।
২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্যারন্যানদো ভ্যালিতে গড়া বিশাল পর্ন ইন্ডাস্ট্রির ১,৫০০ যৌনকর্মীর মধ্যে ২২৮ জনেরই মৃত্যুর কারণ হচ্ছে এইডস, সুইসাইড এবং মার্ডার। এদের বেশীরভাগেরই অকাল মৃত্যু হয়েছে [৫]। এরচেয়েও অবাক করা বিষয় হচ্ছে একজন পর্ন পারফর্মারের আয়ুষ্কাল ৩৬.২ বছর, যেখানে একজন অ্যামেরিকানের আয়ুষ্কাল ৭৮.৬ বছর[৬]।
প্রাচীন রোমানদের বিনোদনের খোরাক ছিল গ্ল্যাডিয়েটরসদের নির্মমভাবে হত্যা হতে দেখা। আর এ যুগে আমাদের বিনোদনের খোরাক হচ্ছে—পর্ন করতে বাধ্য হওয়া মেয়েদের দেখা। যেখানে সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্ন মুভিগুলোর শতকরা ৮৮টিতে থাকে শারীরিক নির্যাতন, শতকরা ৪৯টিতে শোনা যায় গালাগালি, আর ৮৭ ভাগ ক্ষেত্রে কাজগুলো করা হয় নারীদের ওপর[৭]। প্রাচীন রোমানদের হাতে যদি গ্ল্যাডিয়েটরদের রক্তের দাগ লেগে থাকে, তাহলে এ যুগে সব জেনেও যারা পর্নকে ক্ষতিকর মনে করে না, নিছক বিনোদন হিসেবে দেখে, হাতে কি পর্ন ইন্ডাস্ট্রিতে পাচার হওয়া মেয়েদের রক্ত লেগে নেই?
লিখেছেন: মো: সাদেক হোসেন মিনহাজ
রেফারেন্স
[১] “IUGULA, VERBERA, URE!”, বই: কখনও ঝরে যেও না, পৃ: ১১৫-১১৬
[২] University of New England, “Human Sex Trafficking: An Online Epidemic #Infographic” (2015). Retreived by http://www.visualistan.com/…/human-sex-trafficking…
[৩] Thorn, “A Report on the Use of Technology to Recruit, Groom, And Sell Domestic Minor Sex Trafficking Victim (2015). Retrieved from https://www.wearethorn.org/…/02/Survivor_Survey_r5.pdf
[৪] Dr. Karen Countryman-Roswurm, LMSW, Ph.D. Interview || Truth About Porn [Video file]. (2016, December 28). Retrieved from https://vimeo.com/190317258
[৫] Book: Truth behind the fantasy of porn
[৬] Pink Cross Foundation
[৭] Pornography harms, https://endsexualexploitation.org/
COMMENTS